সুখের সন্ধানে-১

শ্রাবনের রাত, ফাকা রাস্তা, চারিদিকে ভিজে ভিজে ভাব, একটা কুকুর ডাকছে রাস্তাই, আর একটা সোলার লাইট জ্বলছে রাস্তার পাশে। সেই রাস্তাই হাটছে এক ছেলে,দ্রুত তার পায়ের গতি। সে জানে না সে কোথায় যেতে চাই, কি তার উদ্দেশ্য? কি তার গন্তব্য?


সে এই রাস্তা আলো কিছু দেখছে না। আসলে আজ তার প্রিয় একজন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। আজ সন্ধ্যা তেও সে জানতো না এই খবর, সন্ধ্যা তে প্রতিদিনের মতোই পড়াতে গিয়েছিল সে।


এক ক্লাস ওয়ানের মেয়েকে পড়াতে যায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে। এমনিতে এই পড়াতে যাওয়া নিয়ে তার মনে ঘোর অইচ্ছা। কিন্তু টাকা টা খুবই দরকার তার সেইজন্য অইচ্ছা থাকলেও রোজই পড়াতে যায় সে। দুইবছর আগে মারা গেছে ছেলেটার বাবা, বাড়ি এখন মধ্যবয়স্ক মা আর সে। সংসার টা ভালো ভেবেই চলে যায়। কিন্তু ছেলেটা নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য তার মায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই না তাই এই টিউশন টা সে নিয়েছে।


যে বাড়িতে পড়াতে যায় সেই বাড়িতে ওই বাচ্চা তার মায়ের সাথে থাকে। মায়ের নাম ববিতা । বয়স ত্রিশের বেশি। দেখতে রীতিমতো সুন্দর, ফর্সা গায়ের রং, উচ্চতা মাঝারি রকমের,বাচ্চা হওয়ার পর পেটে সামান্য মেদ জমেছে যা তার সৌন্দর্য কে আরও বাড়িয়ে তুলেছে,দুধ আর পাছা যে বেঢপ মোটা তা না,কিন্তু যথেষ্ট মানানসই,এই সৌন্দর্য দেখলে এমনিই ভক্তি আসে,(অনেক টা মির্জাপুর সিরিজের জারিনার মতো দেখতে)বাইরে গেলে সবসময় শাড়ি পরে,তাতে পেটের একটু অংশও উন্মুক্ত করে রাখে না।তার স্বামীর নাম রাজু।বিদেশে থাকে।তিন বছরের প্রেম তারপর তারা বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল তাও আজ থেকে দশ বছর আগের কথা।স্বাভাবিক ভাবেই পরিবার থেকে তাদের সম্পর্ক টা মেনে নেয়নি ফলে তারা তাদের মা বাবা কে ছেড়ে অন্য স্থানে বাস করতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে ভালোবাসাটা এখন অনেক টা থিতিয়ে পড়েছে। বাচ্চা হওয়ার আগে তারা নিয়মিত নিজেদের মধ্যে মিলিত হতো, ঘুরতে যেত বিভিন্ন স্থানে, তারা দুজন ছিল দুজনের জন্য অন্য কারো তাদের প্রয়োজন নেই এমন মনে হতো। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর ববিতা বাচ্চা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তার কয়েক মাস পর রাজুও চলে যায় বিদেশে কাজের জন্য। রাজু প্রায় পাঁচ বছর বিদেশে আছে এর মধ্যে সে বাড়িতে এসেছে মাত্র একবার তাও তিন মাসের জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই এই বাড়িতে ববিতাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ নেই তার বাচ্চা টি স্কুলে চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়িতে তার দম বন্ধ মতো লাগে।


এরই মধ্যে তার মেয়ে ক্লাস ওয়ানে উঠলো। এতোদিন মেয়েকে ববিতা নিজেই পড়াতো কিন্তু তার মেয়ে এখন আর তার কাছে পড়তে চাই না। এইজন্যই সে একজন কে খুজছিল যে বাড়িতে এসে তার মেয়ে কে পড়াবে। তার মেয়েরই এক সহপাঠীর মায়ের থেকে সে খবর পেল সেই ছেলেটির। একই গ্রামে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও ববিতা কখনো এই ছেলেকে দেখেনি। জানতে পারলো ছেলেটির নাম হিমু। সদ্য কলেজে উঠেছে।


এরপর সেই সহপাঠীর মায়ের দ্বারা যোগাযোগের মাধ্যমে ঠিক হলো হিমু ববিতার বাড়িতে পড়াতে যাবে। রোজ সন্ধ্যা তে, সপ্তাহে চারদিন। ববিতা ভেবেছিল গ্রামের কোন সাধারণ দেখতে ছেলে হয়তো পড়াতে আসবে কিন্তু সে দেখলো চেহারাও রীতিমতো হ্যান্ডসাম, 6’2″ হাইট। নিয়মিত ব্যায়াম করার জন্য পেটানো শরীর। হিমুর মুখে একটা মৃদুহাসি সবসময় লেগে থাকে, কথাও খুব বেশি বলে না, ব্যবহার খুব মার্জনীয়, চোখে স্পষ্ট জ্ঞানের ছাপ, কয়েকদিন কথা বলেও বুঝতে পারলো অনেক বিষয়েই সে চর্চা করে সব বিষয়েই তার গভীর ধারণা আছে।


হিমু নিয়মিত পড়াতে আসা শুরু করলো। ববিতার মেয়েও হিমুর কাছে পড়তে অনেক ভালোবাসে। ববিতা মাঝেমাঝে এসে দেখে যায়, কখনো খাবার দিতে আসে। তখন দুই একটা কথা হয় তাও সামান্যই। হঠাৎ করেই একদিন ববিতা অসুস্থ হয়ে পড়লো। শরীর জুড়ে জ্বর, দুর্বলতা। হিমু পড়াতে গিয়ে দেখলো ববিতা বারান্দাতে শুয়ে রয়েছে। মুখে, চোখে স্পষ্ট দুর্বলতার ছাপ। হিমু জিজ্ঞাসা করলো তাকে ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা? সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা? তারপর হিমু পড়াতে আরম্ভ করলো। কিছুক্ষণ পর ববিতা আসলো হিমুকে চা দিতে। চা দেওয়া হয়ে গেলে যেতে গিয়ে দুর্বলতার কারণে ববিতা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। হিমু সাথে সাথে গিয়ে তাকে তুললো। তাকে খাটে বসিয়ে সে গেল ডাক্তার কে ডাকতে। ডাক্তার কে নিয়ে কিছু সময় পরই সে ফিরে আসলে ডাক্তার জানিয়ে দিল শরীরের দুর্বলতার কারনেই এমন হয়েছে। এখন কয়েকদিন শুধু রেস্ট নিতে বললো তাকে।


ডাক্তার চলে যাওয়ার পরও হিমু কিছুক্ষণ থাকলো। ববিতা বললো তার মাথা অনেক যন্ত্রনা করছে। হিমু তখন মাথা ব্যাথা কমানোর মলম তার কপালে লাগিয়ে মালিশ করে দিতে লাগলো। যদিও ববিতা প্রথম এতে আপত্তি করছিল কিন্তু কপালে অনেক দিন পর পুরুষ্টু হাতের স্পর্শে তার ভালোই লাগছিল। এর কিছুক্ষণ পর হিমু বাড়ি চলে আসে কারণ রাত বেড়ে যাচ্ছিল ,আর বলে আসে যদি কোন অসুবিধা হয় তাকে যেন ফোন করে জানায়।


পরের দিন সকাল আটটার মধ্যে হিমু কয়েকটি পরোটা কিনে নিয়ে ববিতার বাড়িতে যায়। তখন ববিতা উঠে রান্নার প্রস্তুতি করছিল। হিমু তার হাতে পরোটা গুলি দিয়ে তাকে রান্না করতে বারন করে। ববিতা এতেই অবাকই হয়। একজন মানুষ আরেকজনের জন্য এতো কি করে? তার নিজের মানুষই কাল থেকে তাকে একবার ফোন করার সময় পাইনি আর এদিকে একটি ছেলে যার সাথে সে কোনদিন পাচ মিনিটের বেশি কথা বলেনি সে তার জন্য কেন এতো করছে? কি স্বার্থ আছে তার। হিমু কিন্তু এইসব কিছুই ভাবছে না। কোনও স্বার্থও নেই তার। সে তার মাকে দেখেছে, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে যদি কোনদিন অসুস্থ হতো, কত অসহায় দেখাতো তাকে। সেই কথা ভেবেই হিমু এই অসহায় বউটির অসুস্থতাই একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।


যায় হোক, এরপর ববিতা পরোটা খেতে খেতে হিমুর সাথে গল্প করতে লাগলো। এই অসুস্থতার মধ্যেও একটা কথা বলার মানুষ পেয়ে তার অনেক ভালো লাগতে লাগলো


দুই একদিনের মধ্যেই ববিতা সুস্থ হয়ে উঠলো। তারপরও তার আর হিমুর মধ্যে যে সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা আরও মজবুত হতে লাগলো। ববিতা লক্ষ্য করছে সে যেন হিমুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠছে, তার কথাবার্তা, তার জীবন নিয়ে ধারণা সবকিছু তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হিমুর দিকে। যে দিন গুলোতে হিমু পড়াতে আসে না সেদিন গুলোতে তার অনেক মন ভার হয়ে থাকে। এর মধ্যেই সে জানতে পেরেছে হিমু অস্মি নামের এক মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাই ববিতা তার এই অনুভূতির কথা হিমুকে বলেনি কোনদিন, সে জানতো বলা সম্ভবও না। সে একজন গৃহবধূ, একজন মা, একজন স্ত্রী।

এর মধ্যে হিমুর পরীক্ষা পড়ে যাওয়ায় সে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নিল। এই এক সপ্তাহ ববিতার কাছে যেন এক বছরের মতো মনে হতে লাগলো। তার খাওয়া, ঘুম সব উড়ে গেল। সে বার বার ফোনে হিমুর নাম্বার ডায়েল করতো কিন্তু ফোন করে সে কি বলবে সেইজন্য আর ফোন করা হয়ে উঠতো না। কিন্তু একদিন সে ফোন করেই ফেললো কিন্তু পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? এই একটা প্রশ্ন ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলো না সে।


এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর হিমু যেদিন পড়াতে আসলো ববিতা আবেগের বশবর্তী হয়ে করে ফেললো একটা ভুল, যা একজন স্ত্রীর পক্ষে আমাদের সমাজে কখনোই গ্রহনযোগ্য না।


হিমু দরজার কাছে এসে দাড়াতেই সে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো হিমুকে। হিমু এমন কিছু আশায় করেনি। সে মুহুর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, সে বুঝতে পারলো না তার কি করা উচিত। তার মনে ভেসে উঠলো অস্মির চেহারা সে তখনই ববিতাকে ঠেলে ছড়িয়ে দিল। ববিতাও যেন এবার বর্তমানে ফিরে আসলো। আর এক মুহুর্তের জন্য সেখানে না দাড়িয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেল। হিমু সেদিন আর পড়াতে পারলো না।


হিমু বাড়ি ফিরে সারারাত ভাবলো , কেন ববিতা তাকে আকড়ে ধরতে চাই? সে তো সুখেই আছে, সফল স্বামী, একটা মেয়ে নিয়ে তার সুন্দর একটা পরিবার। তবে সে কেন হিমুকে জড়িয়ে ধরলো কি তার চাহিদা? সে ভাবলো আর সে পড়াতে যাবে না, কিন্তু না এই মুহূর্তে তার টাকা টার খুব প্রয়োজন।


ববিতাও সেই রাতে অনেক ভাবলো, সে বুঝলো সে ঠিক করেনি, যতই হোক সে নিজের সুখের জন্য একটা সংসার নষ্ট করবে না। এরপর থেকে পড়াতে আসলে সে আর হিমুর সামনে যেত না। হিমুও তাকে দেখলে মাথা নিচু করে নিত।আবার শুরু হলো ববিতার নিঃসঙ্গতার জীবন

এইসব ঘটনার এক সপ্তাহ পর, হিমু সন্ধ্যা তে পড়াতে সে কিছুক্ষণ পড়িয়ে একটা ফোন পেয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেল। তারপর শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। ববিতাও তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।


রাত প্রায় ১১টা । ববিতার বাড়ির দরজাই কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। এতো রাতে তাও বৃষ্টি বর্ষার রাত কে বাইরে? ববিতা মন ভয়ে ছেয়ে গেল। সে উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে দরজার কাছে গিয়ে বললো কে? হিমু খুব আস্তে মাথা না তুলেই বললো আমি হিমু।


তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। ববিতা বুঝলো কিছু তো হয়েছেই।সে দরজা খুললো দেখলো বাইরে ভিজে জামা প্যান্টে দাড়িয়ে আছে হিমু, চোখ অদ্ভুত ধরনের লাল, মুখে বিষন্নতার ছাপ।

পরবর্তী পর্ব

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url